পুষ্টিগুণ।সঠিক পরিমাণ।


নুন বা লবণ এক ধরনের খনিজ যা খাদ্য প্রস্তুতিতে এবং রসায়নে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের খাদ্যাভ্যাসে নুনের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি শুধু স্বাদ বাড়ানোর জন্যই নয়, খাদ্য সংরক্ষণ, স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


* নুনের মৌলিক গঠন:

নুন প্রধানত সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl) নামক রাসায়নিক যৌগ থেকে গঠিত। সোডিয়াম ও ক্লোরিন মৌল দুটি মিলে এই যৌগ তৈরি করে। সোডিয়াম একটি ধাতব মৌল, যা প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজন হলেও অতিরিক্ত মাত্রায় ক্ষতিকর। ক্লোরিন একটি গ্যাস যা ক্ষারক প্রকৃতির। এই দুটি মৌল একসঙ্গে মিশে স্হির, সাদা স্ফটিক নুন তৈরি করে।


পুষ্টিগুণ।সঠিক পরিমাণ।


* নুনের উৎস:

নুনের প্রধান উৎস দুটি: সমুদ্র ও খনিজ সম্পদ। সমুদ্রের পানি বাষ্পীভূত করে নুন সংগ্রহ করা হয়। এটি সমুদ্রের পানি থেকে কৃত্রিমভাবে শুকিয়ে নুন আহরণ করা হয়। অন্যদিকে, খনিজ নুন পাথরের মধ্যে পাওয়া যায় যা খনিজ লবণ বা সল্ট মাইন থেকে উত্তোলন করা হয়। দুটি উৎস থেকেই প্রাপ্ত নুনের বৈশিষ্ট্য কিছুটা ভিন্ন হতে পারে।


* খাদ্য প্রস্তুতিতে নুনের ভূমিকা:

নুন খাদ্যের স্বাদ বাড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন কারণে ব্যবহার করা হয়:


১.স্বাদ বৃদ্ধি: নুন খাদ্যের স্বাদ বাড়াতে সাহায্য করে এবং অন্যান্য স্বাদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে খাদ্যকে সুস্বাদু করে তোলে।

২.সংরক্ষণ: নুনের প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপ্টিক বৈশিষ্ট্য খাদ্য সংরক্ষণে সহায়ক। এটি মাইক্রোবায়াল বৃদ্ধি রোধ করে, ফলে খাদ্য দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ব্যবহারযোগ্য থাকে।

৩.টেক্সচার পরিবর্তন: মাংস ও অন্যান্য খাদ্যপদার্থের টেক্সচার উন্নত করতে নুন ব্যবহৃত হয়।


* স্বাস্থ্যগত দিক:

নুনের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যা হতে পারে:


১.রক্তচাপ বৃদ্ধি: অতিরিক্ত সোডিয়াম গ্রহণের ফলে রক্তচাপ বাড়তে পারে যা হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।

২.কিডনি সমস্যা: উচ্চ সোডিয়াম কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ ফেলতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদী কিডনি সমস্যা তৈরি করতে পারে।

৩.অস্থিরতা: অতিরিক্ত নুন শরীরের তরলের ভারসাম্য বিঘ্নিত করতে পারে, যা বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে।


* নুনের প্রকারভেদ:

নুন বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে:

১.সাধারণ টেবিল সল্ট: এটি সাধারণভাবে ব্যবহৃত নুন যা সূক্ষ্মভাবে পেষা হয় এবং প্রায়ই আয়োডিন যোগ করা হয়।


পুষ্টিগুণ।সঠিক পরিমাণ।


২.সী সল্ট: এটি সমুদ্রের জল থেকে উত্তোলিত হয় এবং এতে প্রাকৃতিক খনিজ উপাদান থাকে।


৩.হিমালয়ান পিঙ্ক সল্ট: হিমালয়ের লবণখনি থেকে উত্তোলিত, এটি একটি গোলাপী রঙের নুন যা আয়রন এবং অন্যান্য খনিজে সমৃদ্ধ।


৪.কোর্স সল্ট: এটি বড় আকারের স্ফটিকযুক্ত নুন যা রান্নার সময় মাংসে ব্যবহৃত হয়।


* নুনের ব্যবহার বাইরেও নুন শুধু খাদ্য সংক্রান্ত কাজে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়:


১.রসায়ন: নুন অনেক রসায়নিক প্রতিক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়।


২.গৃহস্থালী: নুন বিভিন্ন গৃহস্থালী কাজে যেমন ধোয়া-মোছা, পরিষ্কারকরণে ব্যবহৃত হয়।


৩.চিকিৎসা: কিছু প্রাকৃতিক চিকিৎসায় নুন ব্যবহার হয়, যেমন গার্গল করার জন্য বা ত্বকের সমস্যায়।


* পরিবেশগত প্রভাব:

নুন উত্তোলন ও ব্যবহার পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে:


১.মাটি ও জল দূষণ: কিছু ক্ষেত্রে নুন উত্তোলনের ফলে মাটি ও জলদূষণ হতে পারে যা পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।


২.জলাধারের সমস্যা: সমুদ্রের পানি থেকে নুন উত্তোলন পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হতে পারে।


* ইতিহাস ও সংস্কৃতি:

প্রাচীনকাল থেকেই নুন মানুষের জীবনযাত্রার অংশ হয়ে উঠেছে। প্রাচীন মিসরীয়রা খাদ্য সংরক্ষণের জন্য নুন ব্যবহার করত। চীনা, ভারতীয় ও রোমান সভ্যতায়ও নুনের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে নুন এক ধরনের মূল্যবান সামগ্রী হিসেবে গণ্য হতো এবং কিছু কিছু সংস্কৃতিতে এর সাথে বিশেষ সামাজিক ও ধর্মীয় সম্পর্কও ছিল।


* আধুনিক যুগে নুনের ব্যবহারের দিক:

আজকের দিনে নুনের ব্যবহার ও গুরুত্ব আরও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। সঠিক পরিমাণে নুনের ব্যবহার স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রায় সহায়ক, তবে অতিরিক্ত ব্যবহার স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। আধুনিক গবেষণা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে নুনের ভালো-মন্দ প্রভাব সম্পর্কে আরও ভালভাবে জানা সম্ভব হচ্ছে।


এইভাবে, নুন শুধুমাত্র একটি সাধারণ উপাদান নয় বরং মানুষের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই, এর ব্যবহার এবং প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকা জরুরি।



Post a Comment

0 Comments