পলিথিনের ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যগত প্রভাব সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হলো-
ভূমিকা:
পলিথিন, যা পলিথিন টেরেফথালেট (PET) এবং লো-ডেনসিটি পলিথিন (LDPE) এর মতো বিভিন্ন ফর্মে ব্যবহৃত হয়, আধুনিক জীবনের একটি অপরিহার্য উপাদান। এটি সাধারণত ব্যাগ, বোতল, প্যাকেজিং এবং অন্যান্য সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তবে এর ব্যবহার এবং পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত প্রভাব সম্পর্কে গভীর আলোচনা প্রয়োজন।
পলিথিনের ব্যবহার:
১. প্যাকেজিং: পলিথিনের সবচেয়ে প্রচলিত ব্যবহার প্যাকেজিং। খাদ্যদ্রব্য, উপহার এবং অন্যান্য পণ্যের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষায় এটি ব্যবহৃত হয়।
২. ব্যাগ: শপিং ব্যাগ থেকে শুরু করে খাবারের প্যাকেজিং, পলিথিনের ব্যাগগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এগুলি হালকা ওজন এবং জলরোধী হওয়ায় সুবিধাজনক।
৩. বাড়ির ব্যবহার: পলিথিন দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য যেমন মেঝের আবরণ, প্লাস্টিকের টেবিল ক্লথ ইত্যাদি বাড়িতে ব্যবহৃত হয়।
৪. শিল্পে: নির্মাণ এবং কৃষিতে পলিথিনের ব্যবহার দেখা যায়। এটি জলরোধী আবরণ, প্লাস্টিকের ফিল্ম, এবং বিভিন্ন ধরণের সরঞ্জাম তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
স্বাস্থ্যগত প্রভাব:
পলিথিন ব্যবহারের পাশাপাশি এর স্বাস্থ্যগত প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-
১. রাসায়নিক প্রভাব: পলিথিন উৎপাদনের সময় কিছু রাসায়নিক পদার্থ যেমন অ্যাডিটিভস এবং প্লাস্টাইজার ব্যবহৃত হয়। এসব পদার্থ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষ করে,BPA (বিসফেনল এ) এর উপস্থিতি স্বাস্থ্যগত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, যেমন হরমোনের ভারসাম্যহীনতা।
২. বায়ু দূষণ:
পলিথিন বায়ু দূষণের একটি প্রধান কারণ। এর উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অন্যান্য গ্যাস বের হয়, যা বায়ুর মানকে খারাপ করে। পলিথিন পুড়িয়ে ফেলা হলে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়, যা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা ও অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতা সৃষ্টি করে। এছাড়াও, পলিথিনের অক্ষয় সময়কাল দীর্ঘ হওয়ায় এটি পরিবেশে জমা হয়, যা পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত করে। এই কারণে, পলিথিনের ব্যবহার কমানো ও বিকল্প পদার্থ ব্যবহার জরুরি। সচেতনতা বৃদ্ধি ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য পদার্থের ব্যবহার আমাদের বায়ু ও পরিবেশকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে।
৩. জল দূষণ:
পলিথিন জল দূষণের একটি গুরুতর সমস্যা। নদী, হ্রদ ও সমুদ্রে পলিথিনের আবর্জনা জমা হলে তা জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।পলিথিনের মধ্যে রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা জল দূষণ ঘটায় এবং মানব স্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জলজ প্রাণী পলিথিন খাওয়ার ফলে বিষাক্ত উপাদান শরীরে প্রবেশ করে, যা খাদ্য চক্রে প্রবাহিত হয়। এ কারণে, মানব খাদ্যের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে। পলিথিন ব্যবহারের বদলে পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণের ব্যবহার ও সচেতনতা বৃদ্ধি করে আমরা জল দূষণ প্রতিরোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারি।
৪. শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যা: পলিথিনের কারণে সৃষ্ট দূষণের ফলে মানুষ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে, যেমন এলার্জি, ত্বক রোগ এবং অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগ।
পরিবেশগত প্রভাব:
পলিথিনের ব্যবহার পরিবেশের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
১. বর্জ্য সমস্যা: পলিথিনের পুনর্ব্যবহারযোগ্যতা সীমিত। অধিকাংশ পলিথিন বর্জ্য হিসেবে ফেলা হয়, যা মাটি ও জল দূষিত করে।
২. জীববৈচিত্র্যে প্রভাব:পলিথিনের বর্জ্য প্রাণীজগতের জন্য মারাত্মক। অনেক প্রাণী পলিথিন খেয়ে ফেললে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়।
৩. ডাম্পিং সমস্যা: অনেক দেশে পলিথিনের সঠিক ডাম্পিং ব্যবস্থা না থাকায় এর অব্যবস্থাপনা হয়ে থাকে, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
পলিথিনের বিকল্প:
পলিথিনের স্বাস্থ্যগত এবং পরিবেশগত প্রভাবের কথা মাথায় রেখে বিকল্প উপায়গুলি অনুসন্ধান করা জরুরি।
১. বায়োডিগ্রেডেবল উপাদান: বিভিন্ন ধরনের বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক যেমন কাঁসার তেল, স্টার্চ ভিত্তিক প্লাস্টিক ইত্যাদি পলিথিনের বিকল্প হতে পারে।
২. পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান: কাচ, স্টিল এবং ক্যানের মতো পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ ব্যবহারে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
৩. প্রাকৃতিক উপাদান: কাগজ, বেত, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান পলিথিনের পরিবর্তে ব্যবহার করা যেতে পারে, যা পরিবেশের জন্য অধিক উপযোগী।
উপসংহার:
পলিথিনের ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও, এর স্বাস্থ্যগত এবং পরিবেশগত প্রভাবগুলি অসংখ্য। সচেতনতা এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে পারি। বিকল্প উপায় গ্রহণ করে এবং পুনর্ব্যবহারের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারলে পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব। এটি আমাদের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়।
0 Comments