রক্ত মানবদেহের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি একটি জটিল জীবনদায়ী তরল যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য অপরিহার্য। রক্ত মূলত চারটি প্রধান উপাদানে বিভক্ত: প্লাজমা, লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা এবং প্লেটলেট।
১. রক্তের উপাদানসমূহ
১.১ প্লাজমা: প্লাজমা রক্তের তরল অংশ যা রক্তের ৫৫% অংশ নিয়ে গঠিত। এটি একটি সোনালি হলুদ তরল যা প্রধানত জল, প্রোটিন, ইলেকট্রোলাইট, গ্লুকোজ, হরমোন এবং বর্জ্য পদার্থ ধারণ করে। প্লাজমার মূল কাজ হলো রক্তের অন্যান্য উপাদানগুলিকে বহন করা এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে পুষ্টি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করা।
১.২ লোহিত কণিকা (ইরিথ্রোসাইট): লোহিত কণিকা বা রেড ব্লাড সেলস রক্তের ৪৫% অংশ নিয়ে গঠিত। এদের প্রধান কাজ হলো শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড সরানো। লোহিত কণিকার মধ্যে থাকা হিমোগ্লোবিন নামক প্রোটিন অক্সিজেন শোষণ ও পরিবহণের জন্য দায়ী।
১.৩ শ্বেত কণিকা (লিউকোসাইট): শ্বেত কণিকা বা হোয়াইট ব্লাড সেলস শরীরের রোগ প্রতিরোধী সিস্টেমের অংশ। এদের বিভিন্ন ধরনের রয়েছে, যেমন নিউট্রোফিল, লিম্ফোসাইট, মনোসাইট ইত্যাদি। এদের কাজ হলো শরীরের মধ্যে বেগুনি রোগজীবাণু ও অস্বাভাবিক কণিকা সনাক্ত ও ধ্বংস করা।
১.৪ প্লেটলেট: প্লেটলেট বা থ্রম্বোসাইটগুলি মূলত রক্তের জমাটবদ্ধতা এবং ক্ষত স্থান সেরে ওঠার প্রক্রিয়ায় সহায়ক। প্লেটলেটগুলি ক্ষতস্থানগুলিতে জমা হয়ে রক্তপাত বন্ধ করে দেয়।
২. রক্তের কাজ:
রক্তের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে:
২.১ অক্সিজেন পরিবহণ: লোহিত কণিকার মাধ্যমে অক্সিজেন শ্বাসযন্ত্র থেকে অন্যান্য অঙ্গ এবং কোষে পৌঁছে দেয়া হয়।
২.২ পুষ্টি সরবরাহ: রক্তের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান শরীরের কোষে পৌঁছানো হয়।
২.৩ বর্জ্য পদার্থ অপসারণ: রক্তের মাধ্যমে কোষের বর্জ্য পদার্থ কিডনি এবং লিভারে সরানো হয়।
২.৪ রোগ প্রতিরোধ: শ্বেত কণিকা এবং অন্যান্য উপাদান মিলে রোগজীবাণু প্রতিরোধ করে।
২.৫ রক্ত জমাটবদ্ধতা: প্লেটলেটের সাহায্যে ক্ষতস্থান সেরে ওঠার জন্য রক্ত জমাটবদ্ধ হয় এবং রক্তপাত বন্ধ হয়।
৩. রক্তের স্বাস্থ্য ও অসুস্থতা
৩.১ রক্তশূন্যতা (অ্যানিমিয়া): লোহিত কণিকার অভাব বা হিমোগ্লোবিনের ঘাটতির কারণে রক্তশূন্যতা ঘটে। এর ফলে ক্লান্তি, দুর্বলতা এবং অন্যান্য সমস্যা হতে পারে।
৩.২ থ্যালাসেমিয়া:
একটি হেরিডিটরি রক্ত রোগ যা হিমোগ্লোবিনের সমস্যার কারণে লোহিত কণিকার উৎপাদন হ্রাস পায় বা ক্ষুদ্র হয় এবং স্বল্পদিন বাঁচে।
রোগীর দেহে বারবার রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় বলে দেহের বিভিন্ন অংশের লৌহ সঞ্চিত হয়, যার ফলে দেহের বিভিন্ন অঙ্গপতঙ্গ যেমন- হৃৎপিণ্ড, অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি,যকৃৎ প্রভৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া এই রোগে বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং জন্ডিস ক্লান্তি প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দেয়।
৩.৩ লিউকেমিয়া: এটি একধরনের ক্যান্সার যা শ্বেত কণিকার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে ঘটে।
৩.৪ রক্তের ঘনত্ব সমস্যা: কিছু রোগ যেমন থ্রম্বোসাইটোসিস বা থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া রক্তের ঘনত্ব পরিবর্তন করতে পারে।
৪. রক্তের দান ও ট্রান্সফিউশন:
রক্তের গ্রুপ একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনগত বৈশিষ্ট্য যা আমাদের রক্তের ধরন নির্ধারণ করে। প্রধানত চারটি রক্তের গ্রুপ রয়েছে: A, B, AB, এবং O। প্রতিটি গ্রুপ আবার দুটি রেসাস ফ্যাক্টর (Rh) দ্বারা ভাগ করা হয়, যা রক্তের গ্রুপকে Rh-পজিটিভ বা Rh-নেগেটিভ করে তোলে।গ্রুপ A এর রক্তে A অ্যান্টিজেন এবং anti-B অ্যান্টিবডি থাকে। গ্রুপ B এর রক্তে B অ্যান্টিজেন এবং anti-A অ্যান্টিবডি থাকে। গ্রুপ AB এর রক্তে A এবং B উভয় অ্যান্টিজেন থাকে, তবে কোন anti-A বা anti-B অ্যান্টিবডি থাকে না। গ্রুপ O এর রক্তে কোনো অ্যান্টিজেন থাকে না, কিন্তু anti-A এবং anti-B অ্যান্টিবডি থাকে।
রক্তের গ্রুপের সঠিক মিলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে রক্তদান ও রক্তসংক্রান্ত চিকিৎসায়। যদি রক্তের গ্রুপ সঠিকভাবে মেলানো না হয়, তা শরীরের প্রতিরোধী ব্যবস্থা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, যা গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য, সঠিক রক্তের গ্রুপ নির্ধারণ ও মিলানোর জন্য মেডিক্যাল পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি।
৪.১ রক্তদানের প্রক্রিয়া:
রক্তদান সাধারণত একটি সঠিক ও সুরক্ষিত প্রক্রিয়া। দানের সময় একটি পরিষ্কার ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়।
বিশ্বজুড়ে রক্তের অভাব একটি গুরুতর সমস্যা। রক্তদানে প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়, বিশেষ করে গুরুতর দুর্ঘটনা, অস্ত্রোপচার, এবং রক্তের নানা রোগের চিকিৎসায়। রক্তের অভাবের কারণে অনেক রোগী জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা পেতে পারেন না।
৪.২ রক্তগ্রহণ: রক্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় রক্তের বিভিন্ন গ্রুপের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রক্ত নির্বাচন করা হয়। রক্তের গ্রুপের অমিল হলে বিপদজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
৫. রক্তের ভবিষ্যৎ
বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে রক্তের চিকিত্সা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অনেক নতুন নতুন কৌশল ও উদ্ভাবন হচ্ছে। রক্তের রোগ নিরাময়ের জন্য নতুন ধরনের থেরাপি, জেনেটিক গবেষণা এবং অটোমেটেড সিস্টেম উন্নতি পাচ্ছে।
৫.১ রক্তভিত্তিক থেরাপি:
নতুন গবেষণায় রক্তের বিভিন্ন উপাদান যেমন স্টেম সেল ব্যবহার করে রোগ নিরাময় করার নতুন পদ্ধতি বিকাশিত হচ্ছে।
৫.২ টেকনোলজির উন্নতি: উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে রক্ত পরীক্ষার পদ্ধতি আরও দ্রুত ও সঠিক হচ্ছে।
৫.৩ বৈশ্বিক সহায়তা: আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো রক্তের নিরাপত্তা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে।
উপসংহার:
রক্ত মানবদেহের জীবনীশক্তির মূল স্রোত। এর বিভিন্ন উপাদান ও তাদের কার্যাবলি আমাদের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে রক্ত সম্পর্কিত চিকিত্সা ও গবেষণার ক্ষেত্রও বিকশিত হচ্ছে। স্বাস্থ্যবান জীবনযাপনের জন্য রক্তের সুস্থতা রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Cucumber is beneficial for the body click
ডাবের জলে উপকারিতা click Here
দুধের উপকারিতা click here
ওজোন গ্যাস click here
রক্ত সম্পর্কে আলোচনা click here
0 Comments